বাঁশিওয়ালা
~ (ছোট গল্প)

ভোর হতে না হতেই শহরটা খুব ব্যস্ত হয়ে ওঠে। ঠিক শহরের মানুষগুলোর মতো। রাতে ঘুম হোক, বা না হোক, তার কোনও পরোয়া না করে, ক্লান্তিকে পরের দিনের জন্য থামিয়ে রেখে তারা কাজে লেগে পড়ে। মনের মতো শহর। ঝকঝকে অথচ প্রাণের উপস্থিতিও সাজানো, গোছানো। কোথাও খামতি নেই, কোথাও ধুলোময়লা নেই। সব ধরনের মানুষ থাকে এই শহরে। তারা ঘড়ির কাঁটার সাথে তাল মিলিয়ে চলে। এরকমই একটা নিখুঁত শহরে একটা লোকের আমদানি হয়। একটা সাধারণ চেহারার পাগলের সাথে খুব বেশী পার্থক্য নেই লোকটার। বহুদিনের না কাটা চুল-দাড়ি...পুরোনো হয়ে গিয়ে প্রায় ছিঁড়ে যাওয়া জামাকাপড়, শুন্যদৃষ্টিতে চেয়ে থাকা। লোকটা আশ্রয় নেয় শহরের একপাশে থাকা ঝিলসমেত একটা বড় পার্কের একটা জারুল গাছের তলায়। পাশে আবার ওর চেহারা, পোশাকের সাথে মানানসই একটা ঝোলা। ওর মধ্যে কি আছে কে জানে! হয়তো ওর সুস্থ জীবনযাপনের কোনও চিহ্ন আছে ওর মধ্যে।

লোকটাকে প্রথমে চোখে পড়ে রথীনবাবুর। ভদ্রলোক প্রত্যেকদিন অন্ধকার থাকতেই মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে পড়েন। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর রাতের বেলা কোনোদিনই ঠিক করে ঘুম হয়না। ভোর ভোর ঘুম ভেঙে যায়। আর করবেনই বা কি! বাড়ির সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। তাই কাউকে বিরক্ত না করে নিজেকেই নিজের কাজে ব্যস্ত রাখেন উনি। মর্নিং ওয়াক সেরে ফেরার সময় লোকটাকে দেখতে পেলেন উনি। লোকটা বাঁধানো গাছতলা পেয়ে আরাম করে ঘুমাচ্ছিল। ভোরের ঠাণ্ডা হাওয়া ওর চুলগুলো উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো। রথীনবাবুর মনে হল, চোর নয় তো! এই সময় পার্কে কোনও সিকিউরিটি গার্ড থাকেনা জেনেও একবার খুঁজে এলেন। কিন্তু কাউকেই পেলেন না। ভাবলেন এখুনি বাড়ি যাওয়া ঠিক হবে না। একটু পরেই পার্কে লোকজনের ভিড় বাড়তে থাকবে। আরও লোক আসুক। তখন না হয় লোকটার আসার উদ্দেশ্য জানা যাবে।

কিন্তু বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। বেশ কিছুক্ষণ পরে লোকটা নিজে থেকেই উঠে বসল। ইতিমধ্যে লোকটাকে ঘিরে বেশ কিছু লোক জড়ো হয়ে গেছে। আরও লোকজন যারা পার্কে হাঁটতে আসে, তারাও দেখেছে, কিন্তু তারা কোনও ব্যাপারে নাক গলিয়ে নিজেদের সময় নষ্ট করে না। দেখা গেলো, রথীনবাবুর মত কয়েকজনই কৌতূহলী হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। লোকটা উঠে বসে আড়মোড়া ভাঙল। তারপর ঝোলা থেকে একটা ছেঁড়া বিস্কিটের প্যাকেট বের করলো। তারপর পরিষ্কার গলায় বলল, “একটু চা খাব।” সকলে লোকটার নির্লিপ্ত ভাব দেখে বেশ অবাক। কেউ কেউ বলল, লোকটা নির্ঘাত গভীর জলের মাছ। এতো সহজে ওর উদ্দেশ্য বোঝা যাবে না।

তবুও জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হল। ইতিমধ্যে লোকটা রাস্তার মোড়ের একটা দোকান থেকে চা জোগাড় করে এনেছে, সেটাও পয়সা দিয়ে। কাজেই লোকটার ভিখিরি হওয়ার সম্ভাবনা নাকচ করে দেওয়া যায়। প্রশ্নোত্তর পর্ব খানিকটা এরকম।

~“কি করো তুমি?”, রথীনবাবু ফার্স্ট কাম ফার্স্ট সার্ভের ভূমিকা পালন করলেন।

লোকটা উত্তর দেওয়ার দরকার মনে করলো না। আয়েস করে চা খাচ্ছে।

আরেকজন ভদ্রলোক একই প্রশ্ন করলেন, গলা উপরে তুলে। এতক্ষণে লোকটার প্রাতঃরাশ শেষ হল। লোকটা এবারও উত্তর না দিয়ে ওর শতছিন্ন ঝোলা হাতড়ে একটা লাঠির মত কি একটা জিনিস বের করলো। তারপর বলল, “আমি এই করি... বাঁশি বাজাই। আপনাদের কোনও আপত্তি আছে?” এই বলে বাঁশিটা হাতে তুলে ফুঁ দিতে শুরু করলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বাঁশিতে অচেনা অথচ মনে ধরার মতো সুর বাজতে শুরু করলো। লোকজনের ভুল ভাঙলো। সাথে রথীনবাবুরও। একে একে ভিড় কমতে লাগলো। রথীনবাবুও চলে যাচ্ছিলেন। এমন সময় লোকটা বাঁশি বাজানো থামিয়ে ওনাকে ডাকল। বলল, “আপনি সেই ভোর থেকে অপেক্ষা করে আছেন জানি। কখন আমার ঘুম ভাঙবে। আমার ছেঁড়া জামাকাপড়ের নীচে মনটার কথা কখন আপনি পড়ে ফেলতে পারবেন। বুঝলেন কিনা বাবু, অত সোজা কাজ নয়। এই দেখুন আমার বাঁশিটা। এই কটা তো ফোঁকর। কয়েকটা পুরো বন্ধ করলাম, এই আঙুল দিয়ে আধা ফাঁক করে রাখলাম, কটা পুরো ছেড়ে দিলাম। জানতে হয়, কোনটা রাখবেন আর কোনটা ছাড়বেন। তবে তো সুর বাজবে। সাতটা বৈ আটটা তো স্বর নয়। মানুষ চেনাও বাঁশি বাজিয়ে সুর বের করারই মতন।”

(সমাপ্ত)